ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) নবীন এক ছাত্রীকে রাতভর র্যাগিং ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে রবিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত র্যাগিং করা হয় বলে জানা গেছে। এ সময় ওই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণসহ ও নানাভাবে নির্যাতনের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর। এ ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ওই শিক্ষার্থী।
লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী ঘটনার সূত্রপাত ও ওই রাত্রের ঘটনা বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, গত ৯ ফেব্রুয়ারি আমার ডিপার্টমেন্টের ২০২০-২১-এর তাবাসসুম নামের এক সিনিয়র আপু রুমে দেখা করতে বলেন। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে আপুর রুমে যেতে পারিনি। এর পর থেকেই তারা আমার ওপর চড়াও হতে থাকেন এবং পরবর্তী সময়ে তাদের রুমে গেলে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন এবং হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। তারা অভিযোগ করতে থাকেন, তাদের না জানিয়ে কেন হলে উঠেছি? অথচ হলে আমি আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, গেস্ট হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য উঠেছিলাম। কিন্তু প্রথম দফায় শনিবার রাতে আমার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয় এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়। পরে গত রবিবার বিকেল আনুমানিক ৪টায় হল প্রভোস্ট এবং সহকারী প্রক্টরের হস্তক্ষেপে বিষয়টির মীমাংসা হয়।
কিন্তু রাত না পেরোতেই রবিবার দিবাগত রাত আনুমানিক ১১টার দিকে অন্তরা আপুসহ সাত-আটজন আমাকে একটি গণরুমে নিয়ে যান এবং রুমে নিয়ে গিয়ে কথায় কথায় ওনারা সাত-আটজন মিলে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন। আমাকে কেন মারছেন বলতে গেলে ওনারা আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তারা বলতে থাকেন, ‘চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস তুই? কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর?’
আর আমি কান্না করে ওনাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা পা দিয়ে লাথি মারেন। আর অকথ্য ভাষায় আমাকে ও আমার মা-বাবাকে নিয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। এরপর আমার বুকের ওপর হাত দিয়ে জোরে থাবা মারেন এবং গামছা দিয়ে আমার গলায় ফাঁস দিয়ে বারবার টান দিতে থাকেন আর বলতে থাকেন, ‘যা বলব, একটা কথাও যেন বাইরে না যায়। একপর্যায়ে তারা একটা ময়লা গ্লাস মুখ দিয়ে পরিষ্কার করায়ে নেন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করেন। তারপর তারা বলতে থাকেন, জামা খোল। আমি জামা খুলতে না চাইলে তারা আমাকে জোরপূর্বক বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন। তারপর আমাকে বলেন, ‘যদি বাইরের কাউকে এ কথা বলিস, তাহলে তোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেব। যাতে তুই কাউকে মুখ দেখাতে না পারিস।’ এ ছাড়া অন্তরা আপু বলেন, ‘তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব, যা বলেছি তা মনে থাকে যেন।’
টর্চার শেষে রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার পর আমাকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেন। আর সবাই বলেন, মুখ খুললে খবর খারাপ হয়ে যাবে। পরের দিন খুব সকালে জীবন বাঁচাতে আমি হল থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি পাবনায় চলে যাই।
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা সাংবাদিকদের বলেন, সে (নবীন ছাত্রী) সিনিয়রদের সঙ্গে বেয়াদবি করেছিল। ও আমাকে চেনেও না। নবীন ওই ছাত্রী ওর এক ভাইকে দিয়ে ওর বিভাগের সিনিয়রকে (তাবাসসুম) হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। রবিবার প্রক্টর স্যার, প্রভোস্ট স্যার থাকাকালীন বিষয়টা মীমাংসা হয়েছিল। রাতের মধ্যে আর কোনো কিছুই হয়নি। এ ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
ইবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ঘটনাটি শুনেছি। বিষয়টির খোঁজ-খবর নেওয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, প্রথম বর্ষের এক মেয়ে কিছু সিনিয়রদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে বলে অভিযোগ করেছিল কিছু ছাত্রী। পরে আমি ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা মিলে বিষয়টি মিটমাট করে দিই। কিন্তু পরে তার সঙ্গে কী হয়েছে এ বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি। অভিযোগ পেলে আমরা হল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, বিষয়টি জেনেছি। উভয় পক্ষর কথা শুনে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালাম বলেন, র্যাগিংয়ের বিষয়টি আমি শুনেছি। র্যাগিং তো একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো র্যাগিং ছিল না। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়গুলোকে অ্যালাউ করে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিষয়টি বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
কালের কণ্ঠ